আপনার শিশুটি তার খেলনা গাড়িটি দেখিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করল। প্রতিক্রিয়া স্বরুপ আপনি তাকে জানালেন এটা একটা গাড়ি। শিশুটি স্বাভাবিক ভাবেই খেলনা গাড়িটি নিয়ে নারাচারা করতে করতে নিজেনিজেই গাড়ির দৃশ্যমান সম্ভাব্য জ্যমিতিক গঠনগুলোর সাথে পরিচিতি লাভ করবে। এখন পরবর্তীতে যদি আপনি একটি চাকা আকৃতির কোন একটি জিনিস দেখিয়ে বলেন “বলতো এটা কি?” তাহলে সম্ভাব্য ৭০% ক্ষেত্রে উত্তর আসতে পারে “গাড়ি”। ১০% ক্ষেত্রে সে তার পরিচিত অন্য কোন জিনিসের নাম বলতে পারে। অথবা সে নিশ্চুপ থাকতে পারে যার পরিমাণ ২০%।

কথায় আছে আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ দিনের কর্ণধার হিসেবে আজকের শিশুদের কাছেই আমাদের যায়গা ছেড়ে দিতে হবে। বর্তমান সময়ে কমবেশি সকলকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যপারে আগ্রহী হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শিশুদের শিক্ষার ব্যপারে, মানষিক বিকাশের ব্যাপারে, প্রযুক্তিতে উৎসাহী করে তোলার ব্যপারে আমরা কতটা সচেতন। অনেকেই হয়তবা বলবেন “যেখানে আমরাই এখনো প্রযুক্তি ক্ষেত্রগুলোতে বহির্বিশ্বের উপর নির্ভরশীল সেখানে শিশুদের প্রযুক্তিচর্চা পাগলের প্রলাপ মাত্র” । শিশুদের সম্পর্কে আমাদের এই ধারণা গুলোই আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে, বাধাগ্রস্ত করছে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ।

baby1

শিশুদের সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা :

একটা ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সমাজে বহুকাল থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে যে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করার জন্য উপযুক্ত সময় ৬ বছর বয়স । যদিও বর্তমানে কিন্ডারগার্টেন গুলোর মাধ্যমে এই সময় ৪-৫ বছরের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে, কিন্তু গ্রাম অঞ্চলগুলোতে পূর্বের ধারণাই এখনো বহুল প্রচলিত। অনেকের মতে “শিশুদের ৫-৬ বছর বয়সের নিচে শিক্ষাদানের চেষ্টা করা মানষিক নির্যাতন ছাড়া আর কিছু নয়। এই সময় শুধুমাত্র উপযুক্ত খাবার গ্রহণ এবং খেলাধুলাই শিশুদের মানষিক বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে” ।

যদি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার বয়স ৫-৬ বছর হয় তাহলে তাদের প্রযুক্তি চর্চায় অংশগ্রহনের উপযুক্ত সময় কখন?

baby2

শিশুদের সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ:

শিশুদের শিক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু হয় জন্মের পর থেকেই । এ বিষয়ে পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিক্যাল সাইন্সের অধ্যাপক জর্জ হোলিচ এক গবেষণায় উল্লেখ করেন ১২ মাস বয়সের একটি শিশুর স্বাভাবিক শব্দ ধারণ ক্ষমতা থাকে ৬৫-১১০ টি , পরবর্তী ১২ মাসেই এ সংখ্যা বেড়ে পৌঁছায় কয়েক হাজারে। শিশুদের মধ্যে যদি কৌতুহল জাগিয়ে তোলা যায়, অর্থাৎ চারপাশের পবিবেশকে যদি এমনভাবে সাজিয়ে তোলা যায়, যে শিশুটি নিজে থেকেই কৌতুহলী হয়ে উঠে তাহলে তাদের শব্দভান্ডার আরো সমৃদ্ধ হতে পারে । তবে এ প্রক্রিয়াটির সফলতা নির্ভর করে শিশুটির আধো আধো মুখের কৌতুহলী প্রশ্নগুলোর পত্তুতরে পরিবার বা অত্মীয় স্বজনদের প্রতিক্রিয়ার উপর।

বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, আপনার শিশুটি তার খেলনা গাড়িটি দেখিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করল। প্রতিক্রিয়া স্বরুপ আপনি তাকে জানালেন এটা একটা গাড়ি। শিশুটি স্বাভাবিক ভাবেই খেলনা গাড়িটি নিয়ে নারাচারা করতে করতে নিজেনিজেই গাড়ির দৃশ্যমান সম্ভাব্য জ্যমিতিক গঠনগুলোর সাথে পরিচিতি লাভ করবে। এখন পরবর্তীতে যদি আপনি একটি চাকা আকৃতির কোন একটি জিনিস দেখিয়ে বলেন “বলতো এটা কি?” তাহলে

  • সম্ভাব্য ৭০% ক্ষেত্রে উত্তর আসতে পারে “গাড়ি”।big1c
  • ১০% ক্ষেত্রে সে তার পরিচিত অন্য কোন জিনিসের নাম বলতে পারে।
  • অথবা সে নিশ্চুপ থাকতে পারে যার পরিমাণ ২০%।

যদি উত্তরটি “গাড়ি” হয় তাহলে উত্তরটি আপনাকে খুশি করতে না পারলেও বুঝতে হবে আপনার শিশুটি বুদ্ধিমান। কিন্তু শিশুটির কৌতুহলের বিপরীতে আপনার উত্তরটি কতটা সঠিক ছিল বিশ্লেষণ করা যাক।

শিশুরা যখন প্রাথমিকভাবে কোন একটা বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে তখন তারা ঐ বিষয়টির সাথে সম্পর্কযুক্ত বা বিষয়টির অন্তর্ভুক্ত ছোট ছোট বিষয়গুলিকে বাদ দিয়ে পুরো বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে। তাই পরিবারের সদস্যদের উচিৎ শিশুদের সামনে কোন কিছু উপস্থাপন করতে হলে সহজভাবে পুরো বিষয়টির পাশাপাশি বিষয়টির অন্তর্ভুক্ত ছোট ছোট বিষয়গুলিকে উপস্থাপন করা। তা না হলে আপনার শিশুটি চাকাকে গাড়ি বলতে বাধ্য হবে অর্থৎ শিশুটি ভুল শিখবে।

baby3

সাধারণ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে প্রতি তিনটা সঠিক বিষয় শেখার পাশাপাশি নূণ্যতম একটা ভুল শেখে, এই ভুলের পরিমাণ কখনো কখনো ৭-৮টি বা তার বেশিও হতে পারে। বিষয়টি আপনার আদরের শিশুটির জন্য বেশ স্পর্শকাতর। শিশুরা প্রতিটা মুহর্তে তার পরিবেশের কাছে থেকে নতুন নতুন বিষয় শিখে পাশাপাশি তার শিখে ওঠা ভুলগুলোও জমতে থাকে। এই ভুলগুলো আপনার শিশুটির চিন্তাশক্তির বিকাশের সাথে সাথে বিভ্রান্তি রূপে দেখা দেবে ।  বিভ্রান্তিগুলো শিশুদের মেধার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে, লক্ষণ হিসেবে আপনার স্নেহের শিশুটি হয়ে উঠতে পারে আনমনা, অমনোযোগী এবং জেদী ।

baby4

সকল বাবা-মাই তার আদরের সন্তানটিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখে, পরিকল্পনা করে তাদেরকে কিভাবে বড় করে তুলবে, কিভাবে তাকে স্বাস্থ্যবান করে তুলবে, কিভাবে শিক্ষিত করে তুলবে। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় মা বাবা শিশুটির প্রয়োজন, পরিবেশ, প্রগতি, মানষিক প্রতিক্রিয়া, ইচ্ছা অনিচ্ছা ইত্যাদির প্রতি খেয়াল না রেখে তারা অর্থমূল্য এবং পরিমাণ দিয়ে সবকিছুকে বিচার করেন। অনেকেরই ধারণা দামি খাদ্য, দামি পোষাক পরিচ্ছদ, দামি খেলনা, ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেই হল, তার শিশুটি সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে।

baby5

আমরা বলে থাকি এই ছেলেটি খুব মেধাবী, অথবা এই ছেলেটির মেধাশক্তি ভাল নয়, এই ছেলেটি দুরন্ত অথবা শান্ত, এই সবকিছুই একটা ছেলে বা মেয়ের জন্য সম্ভাব্য সত্য। আমরা প্রায়ই এ কথাগুলোও শুনে থাকি মেধাশক্তি স্রষ্টার দান, ছেলেটির মাথায় এক্কেবারে গবর ভরা, এ ছেলেকে দিয়ে কিচ্ছুটি হবে না ইত্যাদি। একজন ডাক্তারকে যদি আদালতে পাঠানো হয় আর একজন উকিলকে যদি অপারেশন থিয়েটারে পাঠানো হয় তাহলে তাদের অবস্থাটি কি হবে একবার ভেবেদেখেছেন। কেউই সঠিকভাবে তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। ঠিক একই ব্যপার শিশুদের মেধাশক্তির বিকাশের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে। আমরা সারা জীবনে আমাদের মেধাশক্তির সামান্য অংশই কাজে লাগাই । তাই সৃষ্টিকর্তা যে কারো মাথায় বেশি বুদ্ধি আর কারো কম দিয়েছেন এটি সঠিক নয়। শিশু এবং চারপাশের পরিবেশ এই দুইএর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই তার মেধাশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বাবা-মাকে তার সন্তানদের ইচ্ছা অনিচ্ছা, প্রয়োজন, চাহিদা, কৌতুহল, আগ্রহ, শখ ইত্যাদি বিশ্লষণ করে তাদের উপযুক্ত পরিবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই আপনার শিশুটি ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে একজন আদর্শ মানুষ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here